কৃষিজমিহীন বিবর্ণ বন্দর
ফরিদ আহমেদ রবি
নারায়ণগঞ্জ তথা দেশের সবচেয়ে ছোট থানা এবং উপজেলা সমূহের অন্যতম বন্দর।আয়তনে ছোট হলেও দেশের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ স্হাপনা এবং ছোট বড় অনেক শিল্পের জন্য বন্দর সুপরিচিত। প্রাচীন কাল থেকেই যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং ভৌগলিক কারণে নানা ধরনের শিল্প ও ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত হয় অঞ্চলটি।ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে নদী তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে ওঠে পাট ব্যবসা কেন্দ্র,পর্যায়ক্রমে নদীর উভয়পাড়ে অসংখ্য পাট, বস্ত্র সহ অন্যান্য শিল্প কারখানা গড়ে উঠে। শিল্পাঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও কৃষিকাজেও বন্দর ছিল অনেক এগিয়ে। নদী তীরবর্তী এলাকায় শিল্প কারখানার পাশাপাশি বিস্তীর্ণ শষ্যক্ষেত্রের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত।বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল নানা ধরনের বৃক্ষরাজি এবং জলাশয় শোভিত। পৌর অঞ্চলের নদী তীরবর্তী স্হান ছাড়াও অনেক জায়গায় আবাদী জমিতে বিভিন্ন ফসলের আবাদ হতো।ইউনিয়ন পরিষদ ভুক্ত পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলের পুরোটাই ছিল কৃষি নির্ভর। জনশ্রুতি রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দামী জাতের তোষা পাট উৎপাদিত হতো বন্দরের সাবদী অঞ্চলে। প্রধান ফসল ধান পাট ছাড়াও অন্যান্য ফসল এবং সবজি চাষের মাধ্যমে এসব অঞ্চলে বসবাসরত মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করতো। আবাদের মৌসুমে দৃষ্টিসীমার প্রায় সবটাই জুড়ে থাকতো শুধু সবুজ আর সবুজ।বর্ষা মৌসুমে চাষাবাদের সুযোগ না থাকলেও জলমগ্ন জমিগুলো পরিণত হতো মৎস্যভান্ডারে,বর্ষাকাল জুড়ে চলতো মাছ ধরার উৎসব।সৌখিন ব্যক্তিদের জন্য আনন্দের খোরাক এই মাছ শিকার কৃষিকাজে নির্ভরশীল শ্রেণীর জন্য হয়ে উঠতো অর্থ উপার্জনের বড় উৎস।একদিকে শিল্প কারখানা পাশাপাশি কৃষিসম্পদে সমৃদ্ধ এমন অঞ্চল সারাদেশেই ছিল বিরল যা এখন শুধুই স্মৃতি।অধিকাংশ শিল্প ছিল কৃষিপণ্য পাট ও তুলা নির্ভর, পরিবেশ বান্ধব। এ অঞ্চলে বসবাসরত প্রতিটি মানুষই শহর এবং গ্রাম উভয় অঞ্চলের সুবিধা ভোগ করতো।বিংশ শতাব্দীর প্রায় শেষাবধি এমন মোহনীয় পরিবেশ অনেকটাই অক্ষুন্ন ছিল।এরপর শুরু হয় ধ্বংসযজ্ঞ।পাট শিল্পের বিলুপ্তি, পরিবেশধ্বংসী বিভিন্ন শিল্প কারখানার বিস্তৃতি, অবাধে বৃক্ষনিধন, ধীরে ধীরে বন্দরবাসীর জন্য অভিশাপে পরিণত হয়।নদী তীরবর্তী পূর্ববর্তী অধিকাংশ শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। সেসব এলাকার বেশিরভাগ আবাসিক এলাকা এবং পরিবেশধ্বংসী শিল্পকারখানায় রূপান্তরিত হয়। নদীতীরবর্তী নয়নাভিরাম বৃক্ষরাজি এবং কৃষিজমির সবুজ চিরতরে বিদায় নেয়, বিবর্ণ রূপ ধারণ করে অঞ্চল সমূহ।অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও আবাসনের বিস্তৃতি শুধু পৌরাঞ্চলে থেমে থাকেনি গ্রাস করেছে কৃষি নির্ভর গ্রামাঞ্চলকেও।এভাবেই অধিকাংশ কুষিজমি হারিয়ে যেতে থাকে অপরিকল্পিত শিল্প ও আবাসন খাতের উদ্যোক্তা ভূমিদস্যুদের আগ্রাসনে।একসময়ের দৃষ্টিনন্দন কৃষিজমি প্রধান বন্দর হারিয়ে যায় শিল্পায়ণ ও আবাসন প্রক্রিয়ার দাপটে,যেখানে চাষাবাদের চিহ্ন মাত্র থাকে না বললেই চলে। একদা দূষণমুক্ত পরিবেশে বসবাস করে বর্তমানে সর্বোচ্চ পরিবেশ দূষণের শিকার হয়ে দিনাতিপাত করছে বন্দরবাসী।এমনতো হওয়ার কথা ছিল না! কৃষিজমি, জলাশয় সংরক্ষণ সংক্রান্ত বিধি বিধান থাকা সত্ত্বেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ হয়নি বলেই এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞ মহলের অভিমত। অধিকাংশ পাটশিল্পের জমি সরকারের নিয়ণ্ত্রণে ছিল। নামমাত্র মূল্যে এসব জমি বিক্রি করে দেয়া হয়।কোন শিল্প বিলুপ্ত হলে সেখানে বিকল্প শিল্প গড়ে ওঠার কথা,তার পরিবর্তে এসব এলাকায় গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত আবাসন এবং পরিবেশধ্বংসী বেশকিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান,এর দায় কে নেবে? আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং কার্যকর নীতিমালার অভাবে কৃষিজমি প্রায় বিলীন হওয়ার পথে। যা কিছু অবশিষ্ট আছে তাতে চাষাবাদ হয় না বললেই চলে। অধিকাংশ জমি শিল্পবর্জ্যের কারণে উর্বরতা হারিয়েছে।এত কিছুর পরও যেসব জমিতে চাষাবাদ হচ্ছে সেগুলোতেও দেখা যায় “বিক্রয় হবে” মর্মে সাইনবোর্ডের উপস্থিতি। অনেক ক্ষেত্রে ভূমিদস্যুদের চাপে পড়ে জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয় জমির মালিকগণ।এমন ধারা অব্যাহত থাকলে অচিরেই বন্দর কৃষিজমি হীন উপজেলায় পরিণত হবে। অধিক মূল্যের আশায় কৃষি জমির মালিকগণ তাদের জমি বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা করবে সেটাই স্বাভাবিক। এই জমিগুলোই যদি মালিকদের জন্য লাভজনক হতো তাহলে নিশ্চয়ই তারা এমন পথে হাটতেন না। শিল্প নির্ভর বন্দরে এ সমস্ত জমিতে অনায়াসে কৃষি শিল্পের বিস্তার ঘটানো সম্ভব। দূষণ রোধ করে এসব জমিতে আবার ফসল আবাদ করাও লাভজনক হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে সাবদী অঞ্চলে গড়ে ওঠা ফুল চাষের কথা ধরা যেতে পারে। ফুল চাষের পাশাপাশি অন্যান্য কৃষিকর্ম, ডেইরি ফার্ম পোল্ট্রি ফার্ম বা মৎস্য উৎপাদন উপযোগী হিসেবে অঞ্চলটিকে গড়ে তোলা যেতে পারে। যা হতে পারে ফুল চাষের মতই অনেক বেশি সম্ভাবনাময়।ব্যক্তি পর্যায়ে এমন ব্যবস্থাপনা কোনভাবেই সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এবং সঠিক নীতিমালা। পরিবেশ দূষণ রোধ এবং জাতীয় স্বার্থে কৃষি জমি সংরক্ষণ সময়ের দাবি। এই মুহূর্তে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে বন্দর একেবারেই কৃষি জমিহীন বিবর্ণ বন্দরে পরিণত হবে। কৃষিজমিতে কৃষি কাজ বা কৃষি শিল্প গড়ে তুলে জমির মালিকরা যেমন লাভবান হতে পারে তেমনি ভাবেই দূঋণমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব।কৃষিজমির মালিকদের উৎসাহিত করতে হলে এগিয়ে আসতে হবে নীতিনির্ধারক মহল সহ সচেতন সকল নাগরিককে।জমির শ্রেণী রূপান্তর আইনি প্রক্রিয়া মেনে সম্পন্ন করার বিধান কঠোর ভাবে মানা হলে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন বা আবাসন কোন ভাবেই সম্ভব হবে না। অধিকাংশ কৃষিজমি ইতিমধ্যেই হারিয়ে গেছে। অল্প কিছু যা আছে তার সঠিক ব্যবহার কিছুটা হলেও বন্দরবাসীর জন্য হবে স্বস্তিদায়ক। কৃষি জমি সংরক্ষণে বন্দরের উদাহরণ দেয়া হলেও এটি সমানভাবে প্রযোজ্য শিল্পাঞ্চল সমৃদ্ধ সমগ্র দেশের জন্য,নয়তো একদিন বন্দরের মতোই বিবর্ণ রূপ ধারণ করবে শিল্পাঞ্চল সমৃদ্ধ সমগ্র দেশ। পুরোপুরি কৃষি নির্ভর বন্দর ফিরিয়ে আনা কোনভাবেই আর সম্ভব নয়, তবে যতটুকু সম্ভব সেই চেষ্টাটুকু নীতিনির্ধারক মহল থেকে করা হলে উপকৃত হবে বন্দরবাসী,কিছুটা হলেও ফিরে পাবে সোনালী অতীত, ঐতিহ্য!
লেখক: বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি ও পোশাক শিল্পের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন...