শান্তির জনপদে হায়েনার থাবা
ফরিদ আহমেদ রবি
ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ নারায়ণগঞ্জ জেলার সবচেয়ে ছোট থানা এবং উপজেলা বন্দর নানাবিধ কারণে বিশেষভাবে পরিচিত।মতভিন্নতা স্বত্বেও রাজনৈতিক এবং সামাজিক সহাবস্থান এখানে বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয়।এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ এলাকাবাসীর সিংহভাগ স্হানীয়,পারিবারিক ও সামাজিক কারণে একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। ক্ষমতার পটপরিবর্তনে একদল ক্ষমতায় আসে অন্যদল ক্ষমতা হারায়।তাতেও দেশের অন্যান্য স্থানের মত প্রতিপক্ষ দলগুলোর মধ্যে তেমন রেষারেষি দেখা যায় না।প্রতিপক্ষ দলগুলো হানাহানির বদলে পারস্পরিক সহাবস্থান বেছে নেয়।সংগত কারণেই রাজনৈতিক সহিংসতা বন্দরবাসীকে তেমনভাবে প্রত্যক্ষ করতে হয় না।রাজনৈতিক এমন সহাবস্থানের কারণে বন্দরবাসীকে অনেকের তীর্যক মন্তব্য সহ্য করতে হলেও অবস্থার তেমন পরিবর্তন অতীতে হয় নি।নির্বাচিত অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি দলমত নির্বিশেষে সবার সাথেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলায় রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা তীব্র হয়ে ওঠার আগেই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় থেমে যায়। অন্যান্য কারণে অপরাধমূলক সহিংসতা কমবেশি নেই এমন বলা না গেলেও রাজনৈতিক সহিংসতা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় লক্ষ্যণীয়ভাবে অনেক কম।এনিয়ে বন্দরবাসীর এক ধরণের গর্ব এবং আত্নতৃপ্তি রয়েছে।দীর্ঘদিনের এই ঐতিহ্য, আত্নতৃপ্তি আজ হুমকির মুখে।বন্দরের শান্তি বিনষ্ট করতে হায়েনার দল থাবা বসিয়েছে।ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর থেকেই রাজনৈতিক সণ্ত্রাস মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে,সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় যার চরম প্রকাশ দেখছে বন্দরবাসী। ক্ষমতার পালাবদলের আগে প্রধান দুটি দলের উপস্থিতি সত্ত্বেও যা ঘটেনি সেই খুনোখুনির ঘটনাও বন্দরবাসীকে দেখতে হচ্ছে,সণ্ত্রাসী বাহিনীর হিংস্র আচরণ নীরবে সহ্য করতে হচ্ছে।গত ২১ জুন রাতে তিন ঘন্টার ব্যবধানে জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে গেল বন্দরে!সংবাদে প্রকাশ মাদক ব্যবসা চাঁদাবাজি অটোস্ট্যান্ড সহ বিভিন্ন অবস্থানে আধিপত্য টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে দুই গ্রুপে এই সংঘর্ষ এবং জোড়াখুন। প্রতিপক্ষ উভয় গ্রুপ একই রাজনৈতিক দলের কর্মী সমর্থক বলে সংবাদে প্রকাশ। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের পারস্পরিক সংঘাত কাঙ্ক্ষিত না হলেও দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মেনে নিতে হয়,এমনটি সুদীর্ঘকাল যাবত চলে আসছে,যদিও বন্দরে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার উদাহরণ খুব বেশি নেই বললেই চলে। সেক্ষেত্রে একই দলের দুই গ্রুপের সংর্ঘষ এবং খুনের ঘটনায় বন্দরবাসী উদ্বিগ্ন, উৎকন্ঠিত হবে সেটাই স্বাভাবিক।বুঝতে অসুবিধা হয় না এখানে দলীয় আদর্শ নয় বরং প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনের উৎস সমূহে নিয়ণ্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা।এক্ষেত্রে স্হানীয় নেতৃবৃন্দের সংশ্লিষ্টতা কতটুকু আছে বা নেই সে বিতর্কে না গিয়ে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষায় তাদের ভূমিকা প্রশ্নবোধক! জোড়াখুনের নির্মম ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২৯ জুন হরিপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ঘটে গেল আরেক ন্যাক্কারজনক ঘটনা।বন্দর উপজেলা পরিষদের দুবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান নিজ দলীয় প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি! বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ঠিকাদারি কাজের প্রয়োজনে সেখানে যাওয়ার সাথে সাথে তিনি প্রতিপক্ষ গ্রুপের হামলার শিকার হন। উল্লেখ্য তাঁর সাথে পুলিশের চারজন সদস্য ছিল।একজন বর্ষীয়ান ব্যক্তিকে আক্রমণ এবং বিবস্ত্র করে ফেলার ঘটনা সত্যি বেদনাদায়ক।যারা এমন ঘটনার জন্ম দিলেন তা কি দলীয় আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে দলীয় স্বার্থে করেছেন?মোটেও না,এখানেও আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার নোংরা মানসিকতা, উপদলীয় কোন্দল প্রভৃতিকে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিদগ্ধ মহল।সামাজিক যোগাযোগ ও সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদ বিশ্লেষণ করে এমন ধারনাই পাওয়া যায়। এতে কার কতটুকু লাভ হলো তা বিশ্লেষণ না করে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় ক্ষতিগ্রস্ত হলো সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলটি!অগনিত কর্মী সমর্থক হতাশায় নিমজ্জিত হলো। সাধারণ মানুষ প্রচলিত রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়লো।রাজনীতি করলে যদি এমন পরিণতির শিকার হতে হয় তাহলে কারই বা রাজনীতির প্রতি আগ্রহ থাকবে? ভুক্তভোগী এ ঘটনার জন্য যাকে দায়ী করেছেন তিনিও একই দলের পার্শ্ববর্তী উপজেলার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তিনি অবশ্য ঘটনার সাথে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন।নেতৃত্ব পর্যায়ে এমন সণ্ত্রাসী ঘটনা ঘটলে তৃণমূল পর্যায়ে জোড়াখুনের মত ঘটনা থামানোর উপায় থাকে কি ভাবে? ক্ষমতার পালাবদলে যখন দলকে সুশৃঙ্খল, জনবান্ধব হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা থাকার কথা, তখন সাধারণ মানুষ অবাক বিস্ময়ে দেখছে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। আধিপত্য বিস্তার, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রভৃতি ব্যাক্তিস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে এমন সণ্ত্রাসী কর্মকাণ্ড মেনে নেয়া কঠিন। বিশেষ করে শান্তির জনপদ খ্যাত বন্দরবাসীর জন্য যা একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত।এমন কর্মকাণ্ড শুধু এলাকাবাসীর শান্তি কেড়ে নিচ্ছে তা নয় দলীয় সমর্থকদের দলবিমুখ করে তুলছে, সাধারণ মানুষ হয়ে পড়ছে রাজনীতি বিমুখ।এমন অবস্থা চলতে থাকলে তা কারও জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না।কলুষিত রাজনীতিকে সুশৃঙ্খল জনবান্ধব করে তুলতে না পারলে জাতির জন্য অপেক্ষা করছে ঘোর অমানিশা।এমন ঘটনা আবারও মনে করিয়ে দেয়,দেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কার,দলীয় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা। ত্যাগী আদর্শ নেতৃবৃন্দকে দল পরিচালনায় সম্পৃক্ত করার বিকল্প নেই। সুবিধাবাদী আদর্শবর্জিত নেতা কর্মীদের ছেঁটে ফেলতে হবে দলীয় স্বার্থে। এমন কাজ অন্য কেউ করে দিবেনা, দায়িত্ব নিতে হবে সংশ্লিষ্ট দলসমূহকে।দলীয় উদ্যোগে দলে সংস্কার করতে হবে।
বন্দরে ঘটে যাওয়া এমন ঘটনা কমবেশি সারাদেশেই ঘটছে যা দেশকে ঠেলে দিচ্ছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।দেশ ও জাতির স্বার্থে এমন অবস্থা থেকে উত্তরণের কোন বিকল্প নেই। সরকারের নীতিনির্ধারক মহল এমন অরাজক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর থেকে কঠোরতর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন যাতে সাধারণ মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরে আসে,দলীয় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলসমূহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে জনসাধারণের আস্হা অর্জন করবে,সাধারণ, শান্তিপ্রিয় মানুষের এমনটিই প্রত্যাশা।
লেখকঃ বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানী ও পোশাক শিল্পের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা
আপনার মন্তব্য প্রদান করুন...